ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। যার কেন্দ্রে ছিল রাজধানীর শাহবাগ মোড়। বৃহস্পতিবার রাতেই জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ। ওসমান হাদির হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে অবরোধ করা হয় শাহবাগ মোড়। ঘোষণা দেয়া হয়, বিচার না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে। গতকাল জুমার নামাজ সেখানেই আদায় করেন বিক্ষোভকারীরা। এরপর হাদির জন্য দোয়া ও বিচার নিশ্চিতের দাবিতে শপথ করেন তারা। শাহবাগ চত্ব্বরের নাম ‘শহীদ ওসমান হাদি’ চত্ব্বর রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। শাহবাগের পাশাপাশি জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে বিক্ষোভ হয়। এদিকে, দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
বৃহস্পতিবার রাতে ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর শোনার পরপরই বিক্ষোভকারীরা হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতকরণ এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে শাহবাগে অবস্থান নেন। এতে যোগ দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, সদ্য সাবেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং মাহফুজ আলমসহ অনেকেই। উত্তাল শাহবাগে চলে মুহুর্মুহু স্লোগান। রাতভর অবস্থান করেন তারা। শুক্রবার সকাল থেকেই ফের বাড়তে থাকে আন্দোলনকারীদের সংখ্যা। জুমার নামাজের পর হাদির জন্য মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। এ সময় হাদিসহ জুলাই আন্দোলনে নিহত-আহতদের জন্য দোয়া করা হয়। সমস্বরে শপথ গ্রহণ করেন তারা। শপথে বলা হয়, হাদির খুনিদের বিচার করা না হলে প্রয়োজনে হাতে অস্ত্র তুলে নেবো। প্রয়োজনে আমরা শহীদ হবো। আমরা এদেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনে জীবন দেবো। আমরা শপথ করছি- ওসমান হাদি ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না। বিকাল ৩টার দিকে সাদিক কায়েমের ঘোষণায় শাহবাগে শুরু হয় ‘আধিপত্যবাদ বিরোধী সমাবেশ’। তিনি শাহবাগের নাম ‘শহীদ ওসমান হাদি চত্বর’ বলে ঘোষণা দেন এবং বলেন, ওসমান হাদির খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাবো না।
হাদিকে গুলি করে হত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস। এ ছাড়া, একই সময় বিক্ষোভ করেন খেলাফত মজলিসের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা, মঞ্চ ২৪ ও সম্মিলিত জুলাই জোট নামে আরেকটি সংগঠন।
বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ
স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে জানান, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে কয়েকটি স্থাপনায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুর করা হয়। প্রথম আলোর সিলেট অফিসে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। নগরের চৌহাট্টা এলাকার আল-পাইন হোটেলসহ কয়েকটি হোটেল ভাঙচুর করা হয়। শুক্রবার বাদ জুমা নগরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করা হয়। সব বিক্ষোভের স্রোত ছিল নগরের চৌহাট্টা ও কোর্ট পয়েন্ট এলাকা। সেখানে পৃথক পৃথক সমাবেশও হয়েছে। এসব সমাবেশ থেকে বক্তারা পালিয়ে যাওয়া হাদির খুনিদের ধরে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি জানান। এদিকে, হাদির রুহের মাগফিরাত কামনায় সিলেটে দোয়া মাহফিল করেছে জামায়াত। শুক্রবার বাদ জুমা নগরীর বন্দরবাজারস্থ কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে সিলেট মহানগর জামায়াতের উদ্যোগে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মাহফিলে সিলেট মহানগরী ও বিভিন্ন থানা-ওয়ার্ড-ইউনিট জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের জনশক্তি ছাড়াও বিপুলসংখ্যক মুসল্লি অংশ নেন। মাহফিলের পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগরী আমীর মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম। মোনাজাত পরিচালনা করেন কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব শায়খ সাঈদ নুরুজ্জামান আল মাদানী এবং যুব জমিয়ত বাংলাদেশ সিলেট মহানগরীর নেতৃবৃন্দ। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা এই মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করে এর তীব্র নিন্দা জানান এবং এর পেছনে থাকা দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছেন।
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, ওসমান হাদি হত্যার প্রতিবাদে শুক্রবার দিনভর বিক্ষোভে উত্তাল ছিল চট্টগ্রাম। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিন্ন দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচির মধ্যে ছিল- মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোয়া, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, কফিন মিছিল ও ব্লকেডের মতো কর্মসূচি। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ছাড়াও জুলাই আন্দোলনে বিভিন্ন প্ল্যাটফরম ও পেশাজীবী নেতারা অংশ নেন। হত্যাকারী ফ্যাসিস্ট অপশক্তির দৃষ্টান্তমূলক বিচারের পাশাপাশি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে বিক্ষোভ মিছিল থেকে সাবেক মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়াও মধ্যরাত পর্যন্ত নগরের খুলশীতে অবস্থিত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চলে। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা রাত দেড়টায় ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের বাসভবনের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। পরে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এরপর থেকে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সামনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী থেকে জানান, হাদির মৃত্যুর খবরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের রাজশাহী মহানগর কার্যালয় গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী গভীর রাতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাজশাহী শহরে প্রবেশ করে। একই সময়ে এনসিপি’র (এনসিপি) নেতাকর্মীরাও পৃথক বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভে অংশ নিয়ে রাজপথে নেমে আসে।
একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা নগরীর কুমারপাড়া এলাকায় অবস্থিত রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে গিয়ে রাতেই একটি এস্কেভেটর দিয়ে ভবনটি গুঁড়িয়ে দেয়।
বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, আন্দোলনকারীরা সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংয়ের বাসভবনে হামলা চালায়। বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বাসভবনের ভেতরে থাকা কয়েক কোটি টাকার জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অগ্নিসংযোগের ফলে বাসভবনে থাকা দু’টি প্রাডো গাড়ি, ছয়টি ফ্যান, দু’টি স্কুটি বাইক, চারটি এসি, টেবিল ফ্যান, পাম্প মোটরসহ আরও বেশ কয়েকটি আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুক্রবার সকাল ১১টায় পুলিশ সুপার কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভকারীরা। এ সময় আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুর সহ তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন তারা।
স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে জানান, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে উত্তাল হয়েছে রংপুর। রাতেই জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, জাতীয় পার্টির প্রতীক ভাঙচুর করা হয়েছে। ওসমান হাদির হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেন ছাত্র-জনতা।
ওসমান হাদির মৃত্যুর পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সহস্রাধিক শিক্ষার্থী রাতে শহীদ আবু সাঈদ চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল করে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীফ ওসমান হাদির গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার বাদ জুমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল মাঠে গায়েবানা জানাজায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলীসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন। জানাজার নামাজ শেষে ওসমান হাদির আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। শোকবার্তা দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী।
স্টাফ রিপোর্টার, হবিগঞ্জ থেকে জানান, ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদ ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলমের পদত্যাগের দাবিতে হবিগঞ্জে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছে। শুক্রবার বেলা ২টার দিকে শহরের কোর্ট মসজিদ পয়েন্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করে। একপর্যায়ে তারা শহরের প্রধান সড়কে অবরোধ করে হাদি হত্যার বিচারের দাবিতে স্লোগান দেন। এ সময় প্রধান সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। পরে বিক্ষোভ মিছিল শেষে আওয়ামী লীগ নেতা সুশান্ত দাশ গুপ্তের বাসা, অফিস ও জেলা আওয়ামী লীগের পরিত্যক্ত কার্যালয় ও বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা।
