বাংলাদেশের ইতিহাস মূলত সম্প্রীতির ইতিহাস। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও এই ভূখণ্ড যুগের পর যুগ সহাবস্থানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই দেশের মানুষ প্রমাণ করেছে যে সহিংসতা নয়, ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চিত্র আমরা দেখছি। তা বড় বেশি অচেনা-গোলমেলে মনে হচ্ছে। তাই মনে প্রশ্ন জাগছে। এটা কি সত্যিই আমার বাংলাদেশ? আমার সম্প্রীতির বাংলাদেশ কি করে এমন হতে পারে?
শরীফ ওসমান হাদি ছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির একজন যোদ্ধা। তিনি শুধু একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও ভোগবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। গত ১২ই ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগর কালভার্ট রোডে খুব কাছ থেকে গুলি করে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় তার জীবন-মৃত্যুর লড়াই।
প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পরে এভারকেয়ার হাসপাতাল এবং সর্বশেষ উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকার এয়ার এম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুর পাঠায়। টানা সাতদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছেন হাদি। অবশেষে সেখানকার চিকিৎসকরা বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর মধ্যদিয়ে থেমে যায় একটি তরুণ প্রতিবাদী কণ্ঠ। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে, তার মৃত্যুর পর আমরা কি করছি?
ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ঢাকায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঢাকার বাইরেও নানা স্থানে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সবমিলিয়ে একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সেনাবাহিনী সময়মতো প্রতিরোধ গড়ে না তুললে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারতো।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা, সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধা, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি। এসব কি কোনো ন্যায়সংগত প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে?
প্রতিবাদ কখনোই সহিংস হতে পারে না। কারণ সহিংসতা শেষ পর্যন্ত আঘাত করে সেই রাষ্ট্রকেই, সেই সমাজকেই। যার পরিবর্তনের জন্য একজন ওসমান হাদি আজীবন কথা বলেছেন।
সুতরাং এখানে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তোলা যায় যে, এই হত্যাকাণ্ডের দায় কার? সরকারের, কোনো অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীর, নাকি এর পেছনে রয়েছে বৃহত্তর কোনো ষড়যন্ত্র?
আমি মনে করি জুলাই চেতনায় বিশ্বাসী কারও পক্ষে এমন সহিংসতা করা সম্ভব নয়।
নিশ্চয়ই এখানে জুলাই চেতনাবিরোধীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
তারা ওসমান হাদিকে হত্যার আবেগকে পুঁজি করে একটি বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চায়। যাতে করে পতিত ফ্যাসিস্টের পুনরাগমন আরও দ্রুত ও সহজ হয়। এখানে আরেকটি বাস্তবতা হলো, জুলাই অভ্যুত্থানের শুরু থেকেই পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার প্রশ্রয়দাতা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এই গণ-আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা সরকার কার্যত ভারতের একান্ত অনুগত সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করাই ওই সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। ফলে হাসিনার পতন ভারতের জন্য শুধু একটি সরকার পতন নয়; এটি ছিল তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে আঘাত। সেই ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে ঘটছে। আমি এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে পারি না।
কিন্তু এখানে এই প্রশ্ন তোলাও খুব স্বাভাবিক যে, সেই ক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় নিজের দেশের সম্পদ ধ্বংস করে, নিজের দেশের মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে কার লাভ? এই সহিংসতা কি ওসমান হাদির আত্মাকে শান্তি দেবে? তিনি কি এতে ফিরে আসবেন?
এই সহিংসতার মাধ্যমে কি আমরা সেই শত্রুদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছি না?
ওসমান হাদি সবসময় কথা বলেছেন অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। তিনি বিশ্বাস করতেন ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ। আজ তার নামে যে সহিংস আন্দোলন হচ্ছে, তা কি তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে, নাকি সেই স্বপ্নকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে?
ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ভয়ভীতি এসব দিয়ে কি দুর্নীতি বন্ধ হয়? চাঁদাবাজি নির্মূল হয়? নাকি উল্টোভাবে আন্দোলনকে বিতর্কিত করে তোলা হয়? বাস্তবতা হলো, এই সহিংসতা কোনোভাবেই হাদির আদর্শের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আমি মনে করি, হাদির ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়ার একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এই ষড়যন্ত্রের বীজ বহু আগে থেকেই বপন করা হয়েছে। আন্দোলনকারী প্রতিটি মানুষকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। সুতরাং আবেগ নয়, সময় এখন বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার।
যারা সহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের নিজেদেরই প্রশ্ন করা উচিত যে, হাদির জন্য কোনটা বেশি প্রয়োজন? শান্তিপূর্ণ, নৈতিক ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন, নাকি ক্ষণিকের উত্তেজনায় রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলা?
ওসমান হাদির হত্যাচেষ্টা ও মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। অনেক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সামনে আসন্ন সময়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। দেড় মাস পর ১২ই ফেব্রুয়ারির বহুল কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন যখন সামনে, তখন এই ধরনের সহিংসতা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বড় ধরনের সংকটে ফেলতে পারে।
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসও হাদির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে। সুতরাং আমাদের সচেতনতার সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে যে, হাদির ঘটনা শুধু দেশের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশকে নতুন করে পর্যবেক্ষণের মুখে ফেলেছে।
চলতি সহিংসতার প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার স্পষ্ট ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে। সরকার জানিয়েছে যে, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন উগ্র গোষ্ঠী দেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে চাইছে। সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও জানমালের ক্ষতির প্রতিটি ঘটনার নিন্দা জানানো হয়েছে।
সরকার আসন্ন নির্বাচন ও গণভোটকে কেবল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করেছে। সরকারের ভাষায়, এই দায়িত্ব জড়িয়ে আছে সেই স্বপ্নের সঙ্গে, যার জন্য শরীফ ওসমান হাদি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার আত্মত্যাগের প্রকৃত সম্মান হবে সংযম, দায়িত্ববোধ ও ঘৃণার রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করা।
এ ছাড়া সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় ডেইলি স্টার, প্রথম আলো ও নিউএজের সাংবাদিকদের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে এবং ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। ময়মনসিংহে এক হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সরকার স্পষ্ট করে বলেছে যে, নতুন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোনো স্থান নেই।
শেষ কথা:
ওসমান হাদির হত্যাচেষ্টা ও তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যা ঘটছে। এটা আমার বাংলাদেশের পরিচয় হতে পারে না। আমার বাংলাদেশ মানে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা আর প্রতিবাদের ভাষায় শালীনতা। পরিবর্তনের পথে শান্তিপূর্ণ দৃঢ়তাই আমাদের এনে দিতে পারে চূড়ান্ত সফলতা।
হাদি আমাদের শিখিয়ে গেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, অন্যায়কারী হয়ে উঠতে নয়। আজ যদি আমরা তার সেই শিক্ষা ভুলে যাই, তবে আমরা একজন হাদিকে কেবল আত্মিকভাবেই হারাবো না বরং আমরা গভীর সংকটে ফেলবো আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের গণতন্ত্র, আমাদের বাংলাদেশকে। সুতরাং আমার বাংলাদেশ কিছুতেই এমন হতে পারে না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা।
ahabibhme@gmail.com
