প্রথম আলো-ডেইলি স্টার কার্যালয় ধ্বংসস্তূপ

প্রথম আলো-ডেইলি স্টার কার্যালয় ধ্বংসস্তূপ

ফন্ট সাইজ:
100%

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে উত্তপ্ত জনতা হামলা চালায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবন। হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রায় ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হয়েছে। শুক্রবার পত্রিকা দুটো প্রকাশিত হয়নি। অনলাইন কার্যক্রমও ছিল প্রায় বন্ধ। এ অবস্থায় দুটো পত্রিকাই বিবৃতিতে দ্রুত তাদের কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দেয়। শুক্রবার বিকালে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করতে গেলে সেখানেও বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করে একদল লোক।

সরজমিন শুক্রবার সকালে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, দুটো পত্রিকার প্রধান ফটকের সামনে ‘ক্রাইম সিন’ লেখা ফিতা টানিয়ে দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পাশাপাশি সিএ ভবন ও ডেইলি স্টার ভবনের পাশেও ক্রাইম সিন ঘোষণা করে জনসাধারণের প্রবেশ সীমিত করা হয়। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে সিআইডি জানায়, অঞ্চলটিকে ‘ক্রাইম সিন’ ঘোষণা করা হয়েছে। কেমিক্যাল এক্সপার্ট টিম আসবে। এবং ভেতরে আলামত সংগ্রহ করবে। সরজমিন প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবনঘুরে দেখা যায়, হামলাকারীদের তাণ্ডবে  ভবনের চারটি তলার যাবতীয় সবকিছু আগুনে পুড়ে গেছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে সকাল থেকেই ছিল উৎসুক মানুষের ভিড়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ভবন দু’টির প্রধান ফটকে দায়িত্বরত অবস্থায় দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। একই অবস্থা ডেইলি স্টার ভবনেও। হামলা, ভাঙচুর আগুনে প্রতিষ্ঠানটির সবকিছু পুড়ে গেছে। ভবনের প্রতিটি তলায় পোড়া ক্ষত। ডেইলি স্টার কার্যালয়ের প্রবেশমুখেই পড়ে ছিল বিভিন্ন পোড়া ধাতব সামগ্রী। ভবনের সামনের অংশের সমস্ত কাঁচ ভেঙে পড়ে আছে। মূল সিঁড়ি ও আশপাশের জায়গা ছাই, কাঁচের টুকরো এবং বিভিন্ন ধাতব সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ভবনের সিলিং বেয়ে পড়েছে পানি। ভবনের দেয়াল পুড়ে যাওয়ায় কালচে হয়ে ছিল। পাশাপাশি ভবনের সামনে পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবি সদস্যরা মূল প্রবেশমুখে অবস্থান করছেন।

শিগগিরই চালু হবে, জানালো প্রথম আলো-ডেইলি স্টার:  রাতে আকস্মিকভাবে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কর্মীদের সবাইকে দ্রুত অফিস ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ফলে শুক্রবার পত্রিকা দু’টি প্রকাশ করা যায়নি। প্রথমবারের মতো প্রথম আলো-ডেইলি স্টার একদিন বন্ধ থাকলো। এই  পরিস্থিতিতে শুক্রবার সকালের দিকে দুটো পত্রিকাই শিগগির চালু হবে বলে জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়। প্রথম আলো বিবৃতিতে জানায়, বিগত রাতে প্রথম আলোর কার্যালয় ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হওয়ায় আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই আজ প্রথম আলো ছাপা পত্রিকা প্রকাশ করা যায়নি। অনলাইন পোর্টালও সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। পাঠকদের কাছে এজন্য আমরা আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। যতটা দ্রুত সম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত কারিগরি ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করে প্রথম আলোর অনলাইন ও পত্রিকার প্রকাশ শুরু করা হবে। একই রকমভাবে ডেইলি স্টারও অনলাইনে বিবৃতি দিয়ে হামলার শিকার হওয়ার বিষয়টি জানায় এবং শিগগিরই চালু হবে বলে পাঠকদের আশ্বস্ত করে।

দুই ফায়ারফাইটার আহত: প্রথম আলো অফিসের আগুন নির্বাপণের সময় মো. আলমগীর হোসেন (৪০) ও মো. শফিউল ইসলাম (৪২) নামের মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের দু’জন ফায়ারফাইটার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত হন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তবে তারা উভয়ই আশঙ্কামুক্ত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানান, আগুন নেভাতে গিয়ে দুই ফায়ারফাইটার বৈদ্যুতিক শর্ট লেগে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে এসেছে। 
মানববন্ধনের হট্টগোল, কয়েক মিনিটেই শেষ কর্মসূচি- প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে এ কর্মসূচি ডাকা হয়। তবে সে কর্মসূচিতে শুরু হয় হট্টগোল। তাই দু’এক মিনিটের মধ্যেই শেষ করতে হয়েছে ওই মানববন্ধন। এ সময় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হকসহ শতাধিক কর্মী অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন কর্মসূচিতে এসে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, পরিকল্পিতভাবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে বলে মনে করি।  

প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা, প্রথম আলোর অবস্থান:  বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোতে হামলার ঘটনায় তাদের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।  প্রতিক্রিয়ায় হামলার ঘটনাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সন্ত্রাসী হামলা বলে জানিয়েছে প্রথম আলো। বলা হয়, প্রথম আলোর কর্মীরা হামলার মুখে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন এবং জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে যান। আক্রমণকারীরা অফিসের ভবন ব্যাপকভাবে ভাঙচুরের পর তাতে অগ্নিসংযোগ করে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা অগ্নিকাণ্ডের কারণে ভবন পুড়ে যায় এবং তাতে সংরক্ষিত সম্পদ ও মূল্যবান নথিপত্র ভস্মীভূত হয়। ওই প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, হামলা, ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে প্রথম আলো প্রতিষ্ঠার ২৭ বছরের ইতিহাসে কোনো সংবাদপত্রজনিত ছুটি বাদে, এই প্রথম শুক্রবার প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। একই কারণে প্রথম আলো অনলাইনের কার্যক্রমও দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রাখতে হয়। প্রথম আলো জানায়, শরীফ ওসমান হাদির দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য এ ছিল একটি কালো দিন। এই ঘটনার মধ্যদিয়ে শুধু আগামী নির্বাচনকে পথভ্রষ্ট করার প্রচেষ্টাই চালানো হয়নি, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করারও লক্ষ্য ছিল। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের প্রকাশের অধিকারের ওপর সরাসরি আক্রমণের একটি সুস্পষ্ট নজির। আমরা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। পাশাপাশি ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানাই।

পাশে আছে সরকার: হামলার ঘটনায় পত্রিকা দু’টির সম্পাদকদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের প্রতিষ্ঠান ও সংবাদকর্মীদের ওপর এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও ন্যক্কারজনক হামলা আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় দু’টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর এই হামলা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হামলার শামিল। এই ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে এক বিরাট বাধা সৃষ্টি করেছে। টেলিফোনে আলাপকালে সম্পাদকদের ও সংবাদমাধ্যমগুলোর পূর্ণ নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন প্রধান উপদেষ্টা।

ওদিকে কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কুষ্টিয়ায় প্রথম আলোর জেলা অফিসে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা হঠাৎ করে অফিসটিতে হামলা চালিয়ে আসবাবপত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম ভাঙচুর করে। হামলাকারীরা অফিসের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি মো. কবির হোসেন মাতুব্বর বলেন, প্রথম আলোর অফিসে ভাঙচুরের বিষয়ে তিনি কোনো তথ্য পাননি। অন্যদিকে, কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, প্রথম আলোর অফিসে ভাঙচুরের ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।  

কোন মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্যকারী হোন!

মন্তব্য করুন